শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৫ অপরাহ্ন
উম্মুল ওয়ারা সুইটি:
আগুন লাগা কি পৃথিবীতে কেউ থামাতে পেরেছে! না পারেনি, আর পারবেও না। আগুন লাগবেই। আর সে আগুন সুযোগ পেলেই ছড়িয়ে পড়বে। এটা তো আগুনের ধর্ম তাই না! আর আগুন নিয়ে যদি কেউ খেলা করে তখন আগুন কিন্তু সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সেই আগুন কোনো বোকা লোক কিংবা স্মার্ট লোক লাগাল নাকি কোনো নিরপরাধ সোজা-সরল মানুষ লাগিয়েছে, কিংবা পাখি তা কিন্তু আগুন বোঝে না। সামান্য সূত্র পেলেই সে খুঁজে বেড়ায় তার সব অনুষঙ্গ, কীভাবে লম্ফঝম্ফ করে দুনিয়াদারি ছাই করবে। কতটা দগ্ধ করবে আর কত দাউ দাউ করবে সেটাই এই আগুনের প্রকৃতি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে যে অগ্নিকাণ্ড হলো সেখানেও আগুন তার ধর্ম বজায় রেখেছে। আগুন দাউ দাউ করে প্রকম্পিত করেছে চারপাশের ছয় থেকে সাত কিলোমিটার এলাকা। নিহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত (এখন পর্যন্ত)। পুড়েও হাসপাতালে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন দুই শতাধিক নিরপরাধ মানুষ।
এত ক্ষমতা মি. স্মার্টের। তিনি এখনো খেলছেন। ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি কি মানুষ না দানব নাকি শিশু? শনিবার রাত থেকে দেশের মানুষের চোখ শুধুই সীতাকু-ের কন্টেইনার ডিপোতে। এই বিএম ডিপোর মালিক স্মার্ট গ্রুপের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মুজিবুর রহমান। তিনি দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্মার্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান একাধিকবার সিআইপি (কমার্শিয়াল ইম্পর্টেন্ট পারসন) মর্যাদা পেয়েছেন।
এখন বারবারই সামনে আসছে যে তিনি কেন এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখলেন স্মার্ট। আর কাজগুলো কীভাবে করলেন এত আনস্মার্ট তথা নির্মমভাবে। রাসায়নিক কনটেইনার কীভাবে রাখতে হবে এবং এই অগ্নিঝুঁকির ব্যবস্থা কী হবে সেটি কীভাবে এই সম্পাদক তথা শিল্পপতি মহোদয় এড়িয়ে যেতে পারলেন? এই প্রশ্নও সামনে আসছে যে, তিনি কীভাবে সবার চোখের সামনে এমন একটা জায়গায় এত বিশাল এই কনটেইনার ডিপো করেছেন! কত পথ পাড়ি দিয়ে এমন একটা ডিপো বানাতে হয়? মানে সরকারের কতগুলো দপ্তর, কত কত কর্মকর্তা ও কত কত প্রতিনিধিদলের পরিদর্শনের ফলাফল এই ডিপো তা সবারই জানার কথা।
মি. স্মার্ট মানে এই ডিপোর মালিক কতটা স্মার্ট হলে এত সব কিছু সামাল দিয়েছেন?
যাই হোক এটা আর নতুন কি? এরকম ঘটনার পর কয়েকদিন খুব আলোচনা চলে, তারপর এই মহাধুরন্ধর মালিকরা পরের কাজও সামলে নেন। আর মানুষ হাহাকারের গল্প আর লাশ বাবদ চাঁদা শেষমেশ কত দাঁড়াল তাই নিয়েই গল্পের ইতি টানেন।
স্বজন হারানো মানুষ এত অসহায় ও নাজুক থাকে যে তারা একটা দুইটা চাকরির বিনিময়ে আবার নিজেকে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। অনেকেই ডিপো কেন প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু আমি বলব কনটেইনার ডিপো তো লাগবেই। আর এই ধরনের ডিপোতে ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার থাকতেই পারে। সেটা তো স্পষ্ট জানতে হবে। প্রশ্ন হলো সেই ডিপো পরিবেশ অধিদপ্তরের সব নিয়ম-কানুন মেনে তৈরি হয়েছে কি না? প্রশ্ন হলো যে ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য কনটেইনার ডিপোতে রাখা হবে তার যথাযথ অনুমতি বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে নেওয়া হয়েছে কি না?
আমি ব্যবসায়ীদের প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, আগুন লাগার পরও কেন ব্যবসার কথা ভাবছেন? কেন সঙ্গে সঙ্গে বলা হলো না এই ডিপোতে রাসায়নিকের কনটেইনার আছে। একটা বড় চুরি ঢাকতে এত প্রাণ কেন নিলেন এই শিল্পপতি-সম্পাদক মহোদয়।
ফায়ার সার্ভিসের ফ্রন্টলাইনযোদ্ধা থেকে শুরু করে পুলিশ, আগুন নেভাতে যাওয়া মানুষ কেউ বাদ যাননি। অগ্নিকাণ্ডের পর পত্রপত্রিকার খবরে আগুন লাগার কারণ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতে যা বেরিয়ে এসেছে তা হলোÑ তথ্য গোপন এবং অবৈধভাবে পরিবেশের ছাড়পত্র পাওয়া, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা সঠিকভাবে না রেখেই কাজ করছিল।
দুদিন পর মালিকপক্ষের একজন চট্টগ্রাম মেডিকেলে বললেন, ‘এটা নাশকতা’।
আমিও তাই বিশ্বাস করতেই চাই, নাশকতা নয় অসাবধানতা। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে তবে এর নিরাপত্তা কোথায়? আর রাসায়নিকের কনটেইনারের হিসাব নেই কেন? আর নাশকতার পর যে ফায়ার সার্ভিস এলো তাতে এই যোদ্ধাদের বিতর্কিত করলেন কেন?
সরকার মহোদয়ের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলতে চাই, আপনারা একটু স্মার্ট হলে তো এত নিরীহ মানুষের প্রাণ যায় না। এখনো এরকম অনেক ডিপো হয়তো আছে যেগুলোতে আগুন ধরার সব উপাদান রয়েছে। নিমতলী, চুড়িহাট্টার মতো এবং সর্বশেষ সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর যদি টনক নড়ে তাহলে তো এত কিছুর দরকার নেই।
যতদূর জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এই কনটেইনার ডিপোতে তৈরি পোশাক, খাদ্য কিংবা ওষুধশিল্পের জন্য নানা ধরনের রাসায়নিক আনা হয়। রপ্তানির জন্য রাসায়নিক সেখানে রাখা হয়। এর মধ্যে বিষাক্ত, দাহ্য বা বিস্ফোরণ ঝুঁকিসম্পন্ন রাসায়নিক থাকে। ফলে বলা মুশকিল আসলে কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত। তবে মোটের ওপর এটা সবাই বুঝেছে, ডিপোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের গলদ ছিল। নিজস্ব ব্যবস্থাপনা দুর্বল থাকায় এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
আমরা জেনেছি ডিপোতে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কনটেইনারের বিস্ফোরণ এই ভয়াবহতাকে বাড়িয়েছে। প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকেই এর দায় মাথায় নিয়ে স্মার্টলি ঘটনার তদন্ত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
ভয়েস/আআ/সূত্র: দৈনিক দেশরূপান্তর।